মাওলানা মোঃ আবু বকর এম.এ :

মহান আল্লাহ তা’লা পবিত্র কোরআন শরীফে এরশাদ করেছেন, তাহারই মহিমা যিনি তাহার বান্ধাকে (মুহম্মদ (সাঃ)কে) এক রজনীতে মসজিদ (কাবা) হইতে দূরতম মসজিদ অর্থাৎ মসজিদে আকসা বা বাইতুল মোকাদ্দাস পর্যন্ত পরিভ্রমণ করাইয়াছিলেন।

(১৭.১)

মেরাজের ঘটনা

নবওয়াতের ১০ম বছর অর্থাৎ বিশ^নবী হযরত মুহাম্মদ (দঃ) ৫০ বছর বয়স কম পেলে রজব মাসের ২৭ তারিখের রাতে এ মহা ঘটনা সংঘটিত হয়। রজনী দ্বিপ্রহর। ঘন অন্ধকারে আকাশ আচ্ছন্ন। নিস্তব্ধ, নির্জন চারিধার। সেদিন পাখি ডাকে নাই। একটা অস্বাভাবিক গাম্ভীর্য্যে প্রকৃতি স্তব্ধ হইয়াছে। হযরত (দঃ) কাবা ঘরের চত্বরে ঘুমাইয়াছেন। এসময় তিনি শুনিতে পাইলেন, কে যেন তাকে ডাকিতেছেন ‘মুহাম্মদ’ হযরতের ঘুম ভাঙ্গিয়া গেল। জাগিয়া দেখিলেন ফেরেস্তা জিবরাইল শিয়রে দন্ডায়মান। অদূরে ‘বোরাক’ নামক একটি অদ্ভুৎ জ্যোতিময় বাহন অপেক্ষা করিতেছে। ডানা বিশিষ্ট অশে^র মত তাহার রূপ। ক্ষিপ্র তাহার গতিবেগ। জিবরাইল প্রথমে হযরতের হৃদয় পরীক্ষা করিলেন। পূর্বের ন্যায় এবারো তিনি তাহার হৃদয়কে শক্তিশালী করিয়া দিলেন। তারপর হযরতকে সে বোরাকে চড়িবার জন্য ইঙ্গিত করিলেন। হযরত বোরাকে আরোহন করিলেন। মুহুর্তের মধ্যে বোরাক হযরতকে লইয়া জেরুজালেমের শীর্ষদেশে আসিয়া উপনীত হইলেন। জিবরাইলের ইঙ্গিতে হযরত সেখানে অবতরণ করিলেন। বোরাককে বাইরে রাখিয়া তিনি জেরুজালেমের মসজিদে প্রবেশ করিলেন এবং সমস্ত নবী-রাসুলদের সাথে নিয়ে পরম ভক্তিতে ’দু রাকাত নামাজ পড়িলেন। হযরত সোলাইমানের প্রতিষ্ঠিত এ পবিত্র জেরুজালেম মসজিদ, হযরত মুসা ও হযরত ইসা (আঃ) এর স্মৃতি ইহার সহিত চির বিজড়িত। ইহাকে কেবলা করিয়া হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এতদিন নামাজ পড়িতেন। আজ সে পবিত্র স্থান স্বচক্ষে দর্শন করিয়া তিনি নিজেকে ধন্য মনে করিলেন। এখান হইতে জিবরাইল হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)কে সঙ্গে লইয়া উর্ধ্ব আকাশপানে উধাও হইয়া চলিলেন। মুহুর্তের মধ্যে তাহারা ১ম আসমানের প্রবেশদ্বারে আসিয়া উপনীত হইলেন। রূদ্ধদ্বারে আঘাত করিতেই ভিতর হইতে প্রশ্ন আসিল কে তুমি! জিবরাইল উত্তর দিলেন আমি জিবরাইল। পুনরায় প্রশ্ন হইল তোমার সঙ্গে উনি কে? উনি কি আল্লাহর বাণী প্রাপ্ত হইয়াছেন? জিবরাইল উত্তর দিলেন উনি আল্লাহর রাসুল মুহাম্মদ (সাঃ)। তৎক্ষনাৎ দুয়ার খুলিয়া গেল। হযরত মুহাম্মদ (দঃ) ভিতরে প্রবেশ করিলেন। জিবরাইল বলিলেন ইনি আপনার আদি পিতা হযরত আদম (আঃ) ইহাকে সালাম করুন। হযরত (দঃ) স্বসম্মানে সালাম জানাইলেন। তখন হযরত আদম (হযরত মুহাম্মদ (দ)কে আলিঙ্গন করিয়া বলিতে লাগিলেন মুবারক হো হে আমার বংশের সর্বশ্রেষ্ট গৌরব।

অতঃপর হযরত মুহাম্মদ (দ) জিব্রাইলসহ দ্বিতীয় আসমানে উপনীত হইলেন। তথায় হযরত ঈসা (আঃ)কে দেখিতে পাইলেন। যথারীতি সালাম সম্ভাষনের পর হযরত ঈসা (আঃ) তাহাকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন হে ন্যায়দর্শী ভ্রাতা খুশ আমদিদ।

এইরূপে তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ট এবং সপ্তম আসমানে প্রবেশ করিয়া হযরত মুহাম্মদ (দঃ) যথাক্রমে হযরত ইউছুুপ, হযরত ইদ্রিছ, হযরত হারুন, হযরত মুসা (আঃ), হযরত ইব্রাহিম (আঃ)কে দেখিতে পাইলেন। প্রত্যেককে তিনি সালাম জানাইলেন এবং প্রত্যেকে পুলকিত চিত্তে হযরতকে অভিনন্দন করিলেন। ইহার পর হযরত মুহাম্মদ (দ) আরো উর্ধ্বে উঠিয়া সেদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত উপনীত হইলেন। এখানে হযরত জিব্রাইল (আঃ) আর অগ্রসর হইতে পারিলেন না। কিন্তু হযরত মুহাম্মদ (দ) নিরন্ত হইলেন না। তাহার যেন ইঙ্গিতে একাই তিনি অগ্রসর হইতে লাগিলেন। মহাশূণ্যের সীমা প্রাচীর পার হইয়া অসীম দিগন্তে এই বুঝি মানুষের প্রথম প্রবেশ কি অসাধারণ এই নভো ভ্রমণ। কত বড় দুঃসাহসীক অভিযান। নিঃশব্দ, নির্জন পথ, সঙ্গীহীন রাত্রি। একটি মাত্র অদৃশ্য ইঙ্গিতে আল্লাহর রাসুল (দঃ) চলিয়াছেন আল্লাহর সান্নিধ্যে। বোরাক তাহার বাহন। সূর্য রশ্মির চেয়েও ক্ষিপ্ত তাহার গতিবেগ। কোন অসীমে কত দূরে কোথায় গিয়া সে থামিবে কে জানে। অদ্ভুত রহস্য লোকের মধ্য দিয়া আজ তাহার প্রমাণ। সকল জ্ঞান, চিন্তা আজ স্তব্দ। শুধু জাগিয়া আছে এক পরম ধ্যান আর আল্লাহর প্রতি এক পরম নির্ভর। “বাইতুল মামুর” পর্যন্ত গিয়া বোরাক গতিভঙ্গ করিল। এ বাইতুল মামুর আর কিছুই নহে। মক্কার কাবা গৃহেরই সত্য রূপ (ঘড়ঁসবহড়হ) অর্থাৎ মক্কার কাবা “বাইতুল মামুরেরই” বাস্তব প্রতিচ্ছবি। বর্তমানে যেখানে কাবা গৃহ দন্ডায়মান ঠিক তাহারই উর্ধ্বদেশে সপ্তম আসমান “বাইতুল মামুর” অবস্থিত। বাস্তব জগতের সহিত এখানের কোন সম্বন্ধ নেই। ইহা নিছক ধ্যান বা কম্প নার জাগ। (ডড়ৎফ ড়ভ রফবধং) ফেরেশতারা প্রতিনিয়ত এখানে আল্লাহর গুণগানে মশগুল থাকে। এক অপূর্ব জ্যোতিতে এ স্থান চির¯িœগ্ধ চির মনোরম। এখানে আসিয়া হযরত (দঃ) আল্লাহর নৈকট্য লাখ করিলেন। একটা পর্দার আড়াল টানিয়া আল্লাহ তাহাকে আত্মরূপ দর্শন করাইলেন। উভয়ের মধ্যে অনেক গোপন কথা হইল। সৃষ্টির লীলার যে রহস্য তখনো হযরতের অজানা ছিল এইবার তাহা সম্যখরূপে তিনি উপলদ্ধি করিলেন। ¯্রষ্টা এবং সৃষ্টিকে তিনি সত্য করিয়া চিনিলেন।

পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের বিধান লইয়া মুহুর্ত মধ্যে হযরত কাবা গৃহে ফিরিয়া আসিলেন। তখন দেখিতে পাইলেন জগত যেমন চলিতে ছিল ঠিক তেমনি চলিতেছে।